২৬ নভেম্বর, ২০১২

রঙ্গিন মন - সাদাকালো টেলিভিশন



ছোটবেলায় (যদিও এখনো যথেষ্ট বড় হইনি) আমাদের বাসায় একটা সাদাকালো টেলিভিশন ছিল । সেই টেলিভিশনটি মোটামুটি পারিবারিক ঐতিহ্য হিসেবেই বাসায় স্থান করে নিয়েছিল । টেবিল চেয়ার থেকে শুরু করে অনেক কিছুই বদলাতো কিন্তু সেই টেলিভিশন বদলাতোনা । বদলানোর প্রয়োজনও ছিলোনা । একটা জিনিষ চলছে, চলুক । আমরা দু ভাই বোন পরম স্নেহ মমতায় সেই ‘ঐতিহ্যকে’ লালন পালন করতাম এবং একি সাথে প্রার্থনা করতাম যেন টেলিভিশনটা দ্রুত নষ্ট হয়ে যায় । নতুন একটা রঙ্গিন টেলিভিশন কেনার ‘উসিলা’ আরকি !!

ডিশের কানেকশন তখনো সজলভ্যতা পায়নি । বিনোদনের জন্য বাসায় একটা ক্যাসেট প্লেয়ার ছাড়া আর কিছু ছিলও না । বাধ্য হয়েই আমরা বিটিভি দেখতাম । ‘বাধ্য’ বললে অবশ্য ভুল , ‘ব্যাপক উৎসাহ’ নিয়েই দেখতাম । বিটিভির অনুষ্ঠানমালা শুরু হতো বেলা তিনটায় । দেখা যেতো দুপুর আড়াইটার দিকে আমি টেলিভিশন চালু করে বসে আছি । আধাঘন্টা বসে বসে টেলিভিশনের পর্দায় ঝির ঝির দেখতাম । খারাপ লাগতো না । তিনটা বাজার সাথে সাথে অনুষ্ঠানমালা শুরু , আমার চোখে মুখে আনন্দ । সেই আনন্দ চলতো বিকাল পর্যন্ত । এরপর খেলাধুলার বিরতি । তারপর আবার সাতটা থেকে শুরু, চলতো রাত এগারোটা পর্যন্ত । মাঝে মাঝে সাড়ে এগারোটায় জাতীয় সঙ্গিত বাজা না পর্যন্ত থামতাম না । জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানিয়ে আর তারপর আবারো মিনিট পাঁচেক ঝির ঝির দেখে ঘুমাতে যেতাম ।


সে সময়ে টেলিভিশনের প্রধান আকর্ষণ ছিল রাত আটটার খবরের পর নাটক অথবা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান । আমি আর আমার বড় বোন প্রধান দর্শক । একসাথে বসে সেই অনুষ্ঠান গুলো হা করে দেখতাম এবং প্রায় প্রতিদিন বসার জায়গা নিয়ে মারামারি করতাম । আমাদের পরিবারের সদস্য চারজন । একমাত্র টেলিভিশনই চারজনকে একত্রিত করার ক্ষমতা রাখতো । আমার একটা প্রিয় অভ্যাস ছিল মুড়ি খেতে খেতে টেলিভিশন দেখা । রাত আটটার দিকে টেলিভিশনের রুম মোটামুটি পরিষ্কার থাকলেও রাত দশটার দিকে পুরো রুম মুড়িতে সয়লাব হয়ে যেতো । গর্হিত এই অপরাধে আমাকে প্রায় প্রতিদিন শাস্তি পেতে হতো । আমি শাস্তি মাথা পেতে নিতাম তারপরেও মুড়ি খাওয়া ছাড়তাম না ।


৯৮ সালের বিশ্বকাপ ফুটবল চলার সময়ে ঘটনা । কোয়ার্টার ফাইনাল চলাকালীন সময়ে ধুম করে টেলিভিশন নষ্ট হয়ে গেল । ব্যাক্তিগতভাবে আমি প্রচণ্ড মন খারাপের ভান করলাম । মনে মনে ধরে নিয়েছিলাম এবার একটা নতুন টেলিভিশন চলে আসবে । বিশ্বকাপ ফুটবল বলে কথা । পাশের বাসায় গিয়ে খেলা দেখার সুযোগ ছিলো , কিন্তু ভাব নিলাম নিজেদের টেলিভিশন ছাড়া কি খেলা দেখে মজা পাওয়া যায় ? সবার কপালে তো আর সুখ সয়না । তিনদিন পর সেই টেলিভিশনটা নিজে থেকেই আবার ঠিক হয়ে গেল । এবার সত্যিকারের মন খারাপ হল !


আরেকবার আমাদের বাসায় চুরি হল । চুরি না বলে ছোটখাটো ডাকাতি বলা যায় । রাতে বাসায় কেউ না থাকার সুবাদে চোরেরা মনের মাধুরি মিশিয়ে চুরি করলো । সোনাদানা, টাকা পয়সা , দামী দামী সব শাড়ি কিছুই বাদ রাখলোনা, এমনকি আমার পড়ার টেবিলে বিশ টাকার একটা নোট ছিল, সেটাও নিয়ে গেল । রাতে তারা চা বানিয়ে খেলো, বিস্কুট খেলো । পরদিন বাসায় ফিরে আমরা হতভম্ব ! পুরো ঘর ওলট পালট । এরি মাঝে আমরা আবিস্কার করলাম চোর অনেক কিছু নিয়ে গেছে কিন্তু টেলিভিশন নিয়ে যায়নি । এ দৃশ্য দেখে আমি আর আমার বোন প্রচণ্ড হতাশ । চোর চুরি করেছে এতে আমরা দুইভাই বোন তেমন দুঃখ পাইনি কিন্তু চোর টেলিভিশন নিয়ে যায়নি বলে আমরা সে তুলনায় কয়েকগুন বেশী দুঃখ পেলাম । ‘টেলিভিশন’ না নেওয়ার অপরাধে রাতে শুয়ে শুয়ে দুইজনে মিলে চোরকে অভিশাপও দিলাম ।


সেই টেলিভিশন চলতে চলতে একটু আধটু ঝামেলা করতো তারপর নিজে থেকেই আবার ঠিক হয়ে যেত । আমি পড়ালেখা বাদ দিয়ে গভীর মনোযোগ সহকারে রাত আটটার সংবাদ দেখতাম, দশটার ইংরেজি সংবাদে ফড়ফড় ইংরেজি বলা দেখে চোখ কপালে তুলতাম । সন্ধ্যায় চায়ের কাপ হাতে নিয়ে চট্রগ্রাম কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিরক্তিকর সব অনুষ্ঠান দেখতাম । প্রচণ্ড ধৈর্য নিয়ে ‘সুর লহরী’ নামক উচ্চাঙ্গ সঙ্গিতের অনুষ্ঠানও দেখতাম । কিছুই বাদ দিতাম না, সবি দেখতাম । অনুষ্ঠানের মান হয়তো খারাপ ছিল কিন্তু মনে ছিল অসীম আনন্দ । টেলিভিশন ছিল সাদাকালো কিন্তু মন ছিল রঙ্গিন ।


‘শকুনের দোয়ায় গরু মরে না’ । আমাদের দুই ভাইবোনের কোন দোয়াতেই টেলিভিশনের কিছু হলোনা । মেড ইন জাপান ‘ন্যাশনাল টেলিভিশন’ শেষ পর্যন্ত বহাল তবিয়তে টিকে রইলো । তবে আমাদের আন্দোলন সংগ্রামের ফলে একদিন ঘরে ‘টুকটুকে’ রঙ্গিন টেলিভিশন এলো । ব্যাপক উৎসাহ নিয়ে ডিশের কানেকশন দেওয়া হলো । সাদাকালো টেলিভিশনটা আমাদের ঘরের কাজের মহিলাকে ‘বিশেষ পুরস্কার’ হিসেবে দিয়ে দেওয়া হল । রঙ্গিন টেলিভিশনের রিমোট চেপে আমরা আনুষ্ঠানিক ভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের সূচনা করলাম ।


কিন্তু তিন নাম্বার দিন রাতে আমরা ভাইবোন আবিস্কার করলাম আমাদের দুইজনেরই মন খারাপ এবং এই মন খারাপের কারন পুরাতন সেই সাদাকালো টেলিভিশন । আমার বোনের ‘অদ্ভুত’ বক্তব্য ছিল ‘বেচারা সাদাকালো টেলিভিশন এতদিন আমাদের সাথে ছিল , অথচ ‘নতুন মানুষ’ পেয়ে আমরা তাকে ঘর থেকে বের করে দিলাম । আমাদেরকে ফেলে বেচারা টেলিভিশনের নিশ্চয়ই অনেক মন খারাপ হচ্ছে !!’টেলিভিশনের মন খারাপের কথা ভেবে আমাদেরও মন খারাপের মাত্রা বাড়তে থাকলো । যন্ত্রের কোন মন থাকেনা সেটা বোঝার বয়স তখন দুইজনেরই ছিল । তারপরেও আমরা আমাদের পরিবারের পঞ্চম সদস্য সাদাকালো টেলিভিশনের কারনে মন খারাপ করে বসে রইলাম।


#

সেই দিন গুলো অনেক আগেই হারিয়ে গেছে । বোনের বিয়ে হয়ে গেছে । এখন বাসায় মানুষ আমরা তিনজন আর টেলিভিশন দুটো । যার যার পছন্দের চ্যানেল আলাদা । আম্মার পছন্দের অনুষ্ঠানের সময় আব্বা মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন আবার আব্বার পছন্দের অনুষ্ঠানের সময় আম্মা মুখ গোমড়া করে বসে থাকেন । টেলিভিশন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের ঐক্যমত কখনই হয়না । আমার পছন্দের তেমন কিছু নেই । দুই সেকেন্ড পর পর চ্যানেল বদলে বদলে দেখতে থাকি । একা একা দেখতে হয় বলে তেমন কিছুতেই আনন্দ পাইনা । আবার আমার বোন যখন বাসায় আসে তখন আবার স্টার প্লাসের যন্ত্রনা সহ্য করতে হয় । চোখ-কান বন্ধ করে থাকা ছাড়া উপায় থাকেনা ।

এখন চাইলেও সবাই একসাথে বসে একটা অনুষ্ঠান দেখা হয়না । টেলিভিশনের চ্যানেল আমাদের মাঝে দূরত্ব বাড়িয়ে দিয়েছে । মাঝে মাঝে মনে হয় ছোটবেলার মনের রঙ এখন টেলিভিশনের কাচের ভেতরে বন্দী ।


হারানো দিনগুলো সবসময়ই আনন্দের হয় । এমন না যে আবার সাদাকালো টেলিভিশন কিনে ফেললে সব কিছু আগের মত হয়ে যাবে । আমরা বড়রা (আমার বেলায় বড় না হয়ে হবে ‘মাঝারি’) ছোটবেলাকে খুব মিস করি । আর যারা ছোট তারা বড় হওয়ার জন্য প্রতিদিন আপ্রান চেষ্টা করে । ছোটরা একদিন বড় হয় ঠিকই আর তখন তারা একটা কঠিন সত্য আবিস্কার করে, ‘চাইলেও আর কোনদিন ছোটবেলায় ফিরে যাওয়া যাবেনা...’