২৯ নভেম্বর, ২০১২

ডিজুস ফটিকের ‘ছুটি’ (রবি ঠাকুরের ‘ছুটি’ গল্প অনুকরনে রচিত)

বালকদিগকের সর্দার ফটিক চক্রবর্তীর মাথায় চট করিয়া একটা নতুন ভাবোদয় হইলো। নদীর ধারে একতলা টিনশেডের বাসায় থাকা সদ্য হাইস্কুল উত্তীর্ণ ‘মলির’ উদ্দ্যেশ্যে একখানা প্রেমের উড়োচিঠি পাঠানো হইবে ।
ইহাতে মলির বাবার যে কতখানি বিস্ময় , বিরক্তি এবং অসুবিধা হইবে তাহাই উপলব্ধি করিয়া বালকেরা এ প্রস্তাবে সম্পূর্ণ অনুমোদন করিলো।
কাগজ কলম লহিয়া সবাই যখন প্রেমপত্র লিখায় ব্যাস্ত তখন ফটিকের কনিষ্ঠ ‘মাখনলাল’ আসিয়া বাধ সাধিলো । কারন মাখন যে মনে মনে ‘মলিকে’ পছন্দ করিত। তাই সে তীব্র প্রতিবাদ জানাইয়া কাগজের উপরেই বসিয়া থাকিলো ।
ফটিক আসিয়া ধমক দিয়া বলিলো ‘যা, ফুট, তুই না থাকলে নাই, তোরে ছাড়াই লেখুম’। মাখন কোন অবস্থায় সরিলো না। ‘পেয়ার কি লিয়ে সালা কুছ ভি কারেগা’ ভাব লহিয়া বসিয়া থাকিলো।

ফটিকের উচিত ছিল অনতিবিলম্বে চড় কষাইয়া দেওয়া। কিন্তু সাহস হইলনা । যেন ইচ্ছা করিলেই এখনি উহাকে শাসন করিতে পারে কিন্তু করিলো না। কারন পূর্বাপেক্ষা আর একটা ভাল বুদ্ধি মাথায় উদয় হইয়াছে। ফটিক প্রস্তাব করিল – ‘এই চিঠির নিচে ‘ইতি- তোমার মাখনলাল ‘ লেখিয়া দিয়া হইবে ।
প্রস্তাব শুনিয়া বালকেরা হৃষ্ট হইয়া উঠিলো । কিন্তু মাখন তৎক্ষণাৎ লাফ দিয়া উঠিয়া অন্ধভাবে ফটিক ও উহার সাঙ্গপাঙ্গকে মারিতে লাগিলো । পরিকল্পনা জলে ভিজিয়া গেলো ।

গলির মোড়ের দোকান হইতে ফটিক দুই টাকার চুইঙ্গাম কিনিয়া বসিয়া চিবাইতে লাগিল। আর আজকের এই ঘটনার ফলে তাহার মনে যে ভাবের উদয় হইয়াছে উহা ফেসবুক স্ট্যটাসে প্রদান করিলো- ‘ভাই বড় ধন, রক্তের বাঁধন , যদিও পৃথক হয় নারীরই কারন।‘ স্ট্যাটাস দিতে দিতে ফটিকে ‘নেত্রকোনায়‘ জলও আসিয়া পড়িল ।

এমন সময় একটি অর্ধবয়সী কাঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাঁড়িওয়ালা ভদ্রলোক আসিয়া জিজ্ঞেস করিলেন ‘বাড্ডি , চক্রবর্তীদের বাড়ি কোথা ?’
ফটিক চুইঙ্গাম চিবাইতে চিবাইতে বলিলো – ‘অই হোতা’! কিন্তু কোন দিকে দেখাইলো কাহারো বুঝিবার সাধ্য রহিল না ।

ভদ্রলোক বিরক্ত হইয়া চলিয়া গেলেন এবং সম্ভবত গুগল ম্যাপের সাহায্য লাহিয়া বাড়ি খুজিতে লাগিলেন।
এমন সময় ফটিকের মোবাইলে তাঁর মায়ের ফোন আসিল । অনতিবিলম্বে তিনি ফটিককে গৃহে তলব করিয়াছেন । ফটিক মনে মনে বুঝিলো আজ তাহার খবর আছে !!
ঘরে ফিরিতেই ফটিক মায়ের হুংকার শুনিল ‘অপরাধীদের কাউকেই ছাড় দেওয়া হবেনা। এদেরকে দ্রুত বিচারের আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করা হবে।‘
ইহা শুনিয়া ফটিক হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। যাক এইবারের মতো রক্ষা পাওয়া গেলো !!


এমন সময় সেই ফ্রেঞ্চকাট দাড়িওয়ালা আধবুড়া ভদ্রলোকটি গৃহে প্রবেশ করিলেন । ফটিক জানিতে পারিল আধবুড়ো এই ভদ্রলকের নাম বিসশম্ভর বাবু। সম্পর্কে তার মামা । দীর্ঘদিন ‘লিবিয়া’ তে ছিলেন । মাইঙ্কার চিপায় পড়ে সম্প্রতি দেশে ফিরেছেন।

মামা আসায় কয়েকদিন খুব আনন্দে কাটিলো । অবশেষে বিদায় লহিবার দু একদিন পূর্বে বিসশম্ভর বাবু তার ভগিনীকে ছেলেদের পড়াশোনা এবং মানসিক উন্নতি সম্বন্ধে প্রশ্ন করিলেন । উত্তর মোটেও আশাব্যাঞ্জক ছিলোনা । এই বালতিভরা জি.পি.এ ফাইভের যুগে ফটিকের এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি মিলিয়াও ‘জিপিএ ফাইভ’ হয় নাই । ইহার দরুন কোন বিশ্ববিদ্যালয়য়ে পড়িবার সুযোগ উহার ঘটে নাই।

শুনিয়া বিশম্ভর বাবু প্রস্তাব করিলেন তিনি ফটিককে ঢাকা লহিয়া গিয়া নিজের কাছে রাখিয়া শিক্ষা দিবেন। ফটিক ও ফটিকের মা উভয়ই এককথায় প্রস্তাবে রাজী হইলেন । মাখনও কম খুশি হইলো না।

উহার পর থেকে ফটিক আনন্দে বিনিদ্র রাত্রি যাপন করিতে লাগিলো । অবশেষে ঢাকা যাইবার পুরবরাত্রে ফেসবুকে ঢুকিয়া স্ট্যাটাস দিল- ‘Going Dhaka for education, pray for me , lol’ . এমন আবেগসম্পন্ন স্ট্যাটাসে অনেক কমেন্ট আসিলো , dashing munna লিখিলো ‘tui ja ga, onek oshanti disos, koita din shantite thakmu’ ঐ কমেন্টে মাখন লাল সহ আরো সতেরো জন লাইক মারিল !!
অবশেষে যাত্রাকালে আনন্দের ঔদার্যবশত ফটিক তাহার ইন্টারনেট মোডেম ও পেন্টিয়াম টু মানের কম্পিউটারখানা পুত্রপৌত্রাদিক্রমে মাখনকে ভোগদখল করিবার পুরা অধিকার দিয়া গেলো।

ঢাকায় মামাবাড়ি পৌছিয়া মামির সঙ্গে প্রথম আলাপ হইলো। তিন তিনটি ছেলে লইয়া মামি এম্নিতেই সর্বদা আতংকে থাকিতেন তাহার উপরে ১৯-২০ বছর বয়সী আরেকটি ছেলের আগমন মামিকে চিন্তিত করিয়া তুলিল। কারন এই বয়সীদের মতো ‘বদমাইশ’ পোলাপাইন আর নাই । বিভিন্ন বান্দরামি কাজে এদের বিপুল উৎসাহ থাকে । তাছাড়া এই বয়সের ছেলেদের ডাকাত বা ছিনতাইকারী সন্দেহে পিটাইয়া মারিতে জনতা বড়ই আনন্দ পায়।

অল্প কিছুদিনের মধ্যেই ফটিক নামকরা এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে এডমিশন লহিয়া ফেলিলো । ক্লাসে ২৭ টা ছেলে আর ২১ টা মেয়ে । মেয়েগুলার পোশাক দেখিয়া বুঝা যাইতনা উহারা ধনী না গরীব । পাতলা পাতলা গ্যাঞ্জি পড়িয়া ক্লাসে চলিয়া আসিতো । ইহার দরুন পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা ফটিকের জন্য কষ্টকর হইয়া পড়িল।


প্রথম দিকে ফটিকের কোন বন্ধু ছিলোনা , বান্ধবি তো দুরের কথা । কোন মেয়ে তাহার দিকে এক পলকের জন্য তাকাইলে সে উহার নিকট আত্নবিক্রিত হইয়া পড়িত । কালের বিবর্তনে দ্রুত ফটিকের এক বন্ধু জুটিয়া গেলো । উহার নাম ছিল ‘শামছু’ । শামছুর ৯৯% ভাল। তবে মাঝে মাঝে একটু আধটু উলটা পালটা জিনিষ খায় আরকি । আধুনিক ছেলে তো !
শামছুর সহচারযে ফটিকের দ্রুত পরিবর্তন ঘটিতে থাকিল । অল্প কয়েকদিনেই ফটিক সিগারেটে অভ্যস্ত হইয়া গেলো। বেশ ভুশা বদলাইয়া হাংকু পাংকু হইয়া চলিতে শুরু করিল। এবং অল্প কয়েকদিনেই ক্লাসে তার বেশ কতক বান্ধবি জুটিয়া গেলো।

সিগারেটে টান দিতে দিতে শামসু একদিন বলিলো ‘চলো দোস্ত , নতুন একটা জিনিষ খাই , সিগারেটের মতই তবে টেস্ট একটু আলাদা। খাইলে বুঝবা কি চিজ !! সেই নতুন ‘চিজটি’ ছিল ‘গঞ্জিকা’ ! অতঃপর প্রথম দিন খাইয়াই ফটিককে গঞ্জিকার নেশায় পাহিয়া বসিলো। ‘গঞ্জিকা’ সেবন করিতে করিতে ফটিক ‘পঞ্জিকা’ ভুলিয়া গেলো। কার্তিক মাসের পুঁজোর ছুটিতে মামা বলিলেন ‘কি রে ফটিক বাড়ি যাবি না? উত্তরে ফটিক বলিলো ‘পড়াশোনার বড্ড চাপ মামা । প্রেজেন্টেশন , টিউটোরিয়াল, এসাইনমেন্ট , মিডটার্ম , ফাইনাল... life is going to be hell ‘ এই ভাব লহিয়া ফটিক ঢাকাতেই পড়িয়া রহিল ।

গঞ্জিকা হইতে অন্যান্য তরল নেশা জাতীয় দ্রব্য ও ‘বাবা’ সেবনে অভস্ত্য হইতে ফটিকের খুব একটা সময় লাগিল না। সামান্য হাতখরচের টাকা দিয়া কি আর এত দামি দামি জিনিষ খাওয়া যায়? বাধ্য হইয়া ফটিক ক্লাসের বই খাতা বেচিয়া নেশা করিতে লাগিল। বই বিক্রির টাকা শেষ হইয়া পরিলে বই হারানোর কথা বলিয়া নতুন বইয়ের জন্য মামির কাছে টাকা খুজিল। কিন্তু মামি রাগ করিয়া বলিলেন ‘ বেশ করেছো । আমি তোমাকে মাসের মধ্যে পাঁচবার করে বই কিনে দিতে পারি নে।‘ টাকা পাওয়ার আশা বিফলে চলিয়া গেলো ।

টাকা সংগ্রহ করিতে ব্যর্থ হইয়া ফটিক ও শামছু পাগলের মত হইয়া গেলো । শেয়ারবাজারের সুচকের মেজাজ মর্জির সূচকও ক্রমেই নিম্নমুখি হইতে থাকিলো । অতঃপর এক সন্ধ্যায় ফটিক বলিল ‘ঢের হয়েছে , আর না, এইবার আমাদের কিছু একটা করতেই হবে !’
পরিশেষে দুইজনে মিলিয়া একখানা ছোটখাটো ছিনতাই করিবার সিদ্ধান্ত নিল। এই উদ্দেশ্যে তারা কমদামী সেকেন্ডহ্যান্ড একটি চাকু কিনিয়া ফেলিল। আঘাত করিবার উদ্দেশ্যে নয় । ভয় দেখাইবার উদ্দেশ্যে। দুইজনে মিলিয়া অপারেশন এর দিনক্ষনও ঠিক করিয়া ফেলিলো।

পরদিন সন্ধ্যায় চাকু হাতে তারা এক নির্জন গলির অন্ধকার মোড়ে দারাইয়া রহিলো । সিদ্ধান্ত হইলো শামছু চাকু ধরিবে আর ফটিক ব্যাগ অথবা মোবাইল টান মারিবে । সে জন্য কোন তরুণীকে টার্গেট করিতে হইবে । এদেরকে ঘাবড়ে দেওয়া তুলনামূলক সহজ ।

দেখিতে দেখিতে ফোনে আলাপরত রিকশাযোগে এক যুবতী মেয়ে আসিতে লাগিলো । ফটিক ও শামছু উহাকেই টার্গেট করিল । দুরু দুরু বুকে তারা অপেক্ষা করিতে লাগিল।

রিকশা কাছে আসার সাথে সাথে তারা রিকশার গতিরোধ করিল , অতঃপর শামছু চাকু ধরিয়া কাঁপা কাঁপা গলায় বলিল ‘ যা আছে দিয়া দেন আপা, টাইম শর্ট’ । আর ফটিকের কাজ হেচকা টানে মোবাইল আর ব্যাগ নিয়া দৌড় দেয়া। ফটিক যখন মোবাইলের উদ্দ্যেশে শুধুমাত্র হাত বাড়াইয়াছে তখন অকস্মা মেয়েটি চড় মারিয়া বলিল ‘শয়তান , তুই আমার দেহ পাবি কিন্তু ‘ফোন’ পাবি না’ ।
দিনের পর দিন নেশা করিতে না পাইয়া ফটিক এমনিতেই দুর্বল ছিল তার উপরে এমন চড় খাইয়া ফটিক ভুপতিত হইয়া গেলো । আর শামছু বুঝিল ভুল ব্যাক্তি টার্গেট করা হইয়াছে , তাই কালবিলম্ব না করিয়া সে চাকু ফেলিয়া উসাইন বোল্ট হইতে ক্ষিপ্র গতিতে দৌড়াইয়া অদৃশ্য হইয়া গেলো । আর মেয়েটির ‘বাঁচাও’ ‘বাঁচাও’ করা চিৎকারে মুহূর্তেই ঢাকা শহরের অর্ধেক লোক জড়ো হইয়া পড়িল ।
‘অস্ত্রবিহীন’ ছিনতাইকারী পাহিয়া জনতার চোখে মুখে আনন্দের অভিব্যাক্তি ফুটিয়া উঠিল। সময়ের বিন্দুমাত্র অপচয় না করিয়া জনতার ব্যাটিং শুরু হইলো । ফটিক শুধু একটি কথা বলারই সুযোগ পেলো । এখন আমার ছুটি হয়েছে মা, এখন আমি বাড়ি যাচ্ছি।‘