২৯ নভেম্বর, ২০১২

ভুত-ভয়-ভবিষ্যৎ


আপনি কি ভূতে বিশ্বাস করেন ? স্মার্ট উত্তর হচ্ছে ‘করি না’ । আমি আনস্মার্ট মানুষ । অল্প-বিস্তর অশরীরী অলৌকিক ব্যাপার স্যাপারে বিশ্বাস করি । মাঝে মাঝে কমবেশি ভয় ও পাই ! এই ভয়ের ব্যাপারটা ছোটবেলায় আমার একমাত্র বড় বোন খুব অসাবধানতায় আমার কোষের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন । বুবু (বড় বোন) ভুত-প্রেত বা অশরীরীর ব্যাপারে খুবি ভীতু ছিলেন । তার সেই ভয়টা আমার মধ্যেও সংক্রমিত হয়েছিল । উদাহরণ দেই, ভয়ের কারনে ছোটবেলায় আমরা দু ভাইবোন একসাথে ঘুমাতাম । একদিন শোয়ার পর আমার বোন বললেন- ‘নাসিফ, বিছানার পাশ ঘেঁষে ঘুমাতে আমার খুব ভয় করে’ , আমি জানতে চাইলাম ‘কেন?’ বুবু উত্তর দিলেন ‘চোখ বন্ধ করলে মনে হয় বিছানার নিচ থেকে একটা কালো হাত বের হয়ে এসে আমাকে ধরে ফেলবে।’ এই টাইপের অদ্ভুত কথা বলতে বলতে তিনি ঘুমিয়ে পড়তেন । আর এমন ভয়ংকর বিষয় শোনার পর আমার চোখ থেকে ঘুম উধাও হয়ে যেত । আমি যথাসম্ভব বিছানার মাঝামাঝি এসে জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকতাম । শুয়ে পা লম্বা করতেও ভয় হত , যদি ভুত আমার পা চেপে ধরে ?? এভাবে শুয়ে থাকতে থাকতে হাটু ব্যাথা হয়ে যেতো। তখন অল্প সময়ের জন্য পা লম্বা করেই আবার বাঁকা করে ফেলতাম । খুবি কষ্টের ব্যাপার ।

আবার হটাৎ একদিন বুবু বললেন ‘রাতে কখনো আমি খোলা জানালার দিকে তাকাই না’ আমি বললাম ‘কেন?’  বুবু জবাব দিলেন ‘যদি দেখি জানালার ওপাশে কেউ দাড়িয়ে আছে’ । এরপর থেকে আমি রাতের বেলা জানালার দিকে তাকানো বন্ধ করে দিলাম । সকালে জানালা খুলতে গেলেও ভয় করতো , যদি দেখি কেউ একজন জানালার ওপাশে দাড়িয়ে? এভাবে অসংখ্য ভয়ের অনুভূতি তিনি আমার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন । ভয়ে রাতে ঘুম আসতোনা , আর একা একা জেগে আছি ভাবতেই গায়ে কাটা দিয়ে উঠতো । তখন বিভিন্ন উপায়ে বুবুর ঘুম ভাঙিয়ে দিতাম । তিনি খুব বিরক্ত হতেন , বিরক্ত লাগারই কথা । এভাবে ঘুম ভাঙ্গাতে আমারও খুব কষ্ট লাগতো । মাঝে মাঝে যখন প্রচন্ড ভয় লাগতো কিংবা কোন দুঃস্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যেতো তখন বুবুকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে বলতাম , আমাকে ধরে ঘুমিয়ে থাকো , আমার ভয় করছে । তিনি আমাকে এক হাত দিয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়তেন । আমি সাময়িক ভাবে সব ধরনের ভয় থেকে মুক্তি পেতাম ।

আরেকটা আধ-ভৌতিক বাস্তব ব্যাপারে আমার প্রচন্ড ভয় , সেটা হচ্ছে  ‘বোবায় ধরা’  । অনেকের কাছে ব্যাপারটা অপরিচিত , কিন্তু এর সাথে যাদের পরিচয় আছে শুধু তারাই যানেন ‘বোবায় ধরা’ ব্যাপারটা কতটা ভয়ংকর । যারা পরিচিত নন তাদেরকে জানাই,  ‘বোবায় ধরা’ ঘটনাটি আধো ঘুম আধো জাগরণের মধ্যে ঘটে থাকে, আপনি স্পষ্ট আশপাশটা দেখতে পারবেন কিন্তু হাজার চেষ্টা করা সত্ত্বেও হাত-পা কিংবা চোখের দৃষ্টি কিছু নাড়াতে পারবেন না । অনেক সময় দম বন্ধ হয় আসে । সোজা ভাষ্যে প্রচণ্ড ভয়ের অনুভূতি নিয়ে মস্ত্রিস্ক সচল থাকলেও শরীর বন্ধ থাকে ।

চার পাচ মাসে মাসে হটাৎ করে একবার আমাকে এই ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতে হয় । খুব খারাপ অস্বস্তিকর একটা অনুভূতি । সাধারনত এমন সময়ে আমি এক নাগাড়ে কলেমা পড়তে থাকি । এক সময়ে সব স্বাভাবিক হয়ে যায় । তবে শরীর ভয়াবহ ক্লান্ত হয়ে যায় । ব্যাপারটা খুব ভয়ংকর, ইন্টারনেট ঘেঁটে জানতে পারলাম অনেকে এভাবে মারাও যেতে পারে ! ‘বোবায় ধরা’ কালিন অবস্থায় অনেকে গো গো করে শব্দ করতে থাকে । মজার ব্যাপার হচ্ছে তখন কেউ যদি তার শরীরে হাত রাখে তাহলে সাথে সাথে ভয়ংকর এই অবস্থা থেকে পরিত্রান পাওয়া যায় । আমি একা ঘুমাই , দুরভাগ্য যে এমন অবস্থায় আমার শরীরে হাত রাখয়ার মত কেউ নেই ! (বুদ্ধিমানের জন্য ইশারাই যথেষ্ট)

বোবায় ধরার বৈজ্ঞানিক নাম হচ্ছে ‘sleep paralysis or hypnagogic paralysis’ । একে অনেকে ঘুমের মধ্যে শয়তানের চেপে ধরা বললেও এসবের পেছনে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা আছে । সেই ব্যাখ্যা একটু পরে জানাচ্ছি ।

এবার সত্যিকারের একটা ভৌতিক অভিজ্ঞতার কথা বলি, ভয়ংকর কিছু না, তবে ব্যাখ্যা ছাড়া একটা ঘটনা । তখন ক্লাস থ্রি অথবা ফোরে পরি । আমাদের বাসার বাইরে একটা টিনের ঘর ছিল । আকবর নামে এক রিকশাওয়ালা থাকতো সেখানে । টিনের ঘরের ভেতর দিকে পত্রিকা দিয়ে মুড়ানো । আমার একটা প্রিয় কাজ ছিল অবসর সময়ে সেই ঘরে ঢুকে পুরনো পত্রিকার লেখা পড়া । একদিন আকবর ভাই ঘরে ছিলেন না । ঘরের দরজা খোলাই ছিল । আমি একা একা পত্রিকা পড়ছি । হটাৎ দেখি পত্রিকার ভেতর দিয়ে দুটো হাতের কব্জি নড়ে উঠলো, ঠিক আমার চোখের সামনে । ভাবলাম টিনের অপাশ থেকে ফাক ফোকর দিয়ে হাত ঢুকিয়ে কেউ আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছে । আমাদের পাশের ঘরে একটা মেয়ে ছিল , নাম রিনা । আমার চাইতে চার-পাচ বছরের বড় । হয়তো সেই এই কাজটা করছে আমাকে । ভাবলাম হাতে নাতে তাকে ধরা উচিত । দৌড়ে বের হয়ে আসলাম । ২ থেকে ৩ সেকেন্ডের ব্যাপার । তাকিয়ে দেখি টিনের ওপাশে কেউ নেই । আমি অবাক হয়ে গেলাম । টিনের কাছে (ঘরের বাইরের অংশে) গিয়ে বিস্ময়ের মাত্রাটা আরও বেড়ে গেল , এই টিনের কোথাও কোন ফাঁকফোকর নেই । কব্জি পর্যন্ত তো দূরে থাক একটা আঙ্গুল ঢোকানোটাও  অসম্ভব । আমি আরেকবার ওই ঘরে প্রবেশের সাহস পেলাম না । দৌড়ে বাসায় চলে এলাম । তবে এরপর অনেকদিন পর্যন্ত ওই স্থানে গিয়ে টিনের ফাঁকফোকর খোঁজার চেষ্টা করেছি , পাইনি ।

এই ঘটনা ছাড়া আর তেমন কোন ভৌতিক ঘটনার সম্মুখীন হইনি । তবে মাঝে মাঝে প্রচন্ড ভয় পেয়েছি । নিতান্ত অকারনে । আসলে ছোটবেলায় ভয়ের এই অনুভূতিগুলো এখনো দূর হয়নি । এখনো গভীর রাতে হটাৎ করে মনে হয় জানালার ওপাশে কেউ দাড়িয়ে আছে , কিংবা বিছানায় শোয়ার পর মনে হয় এই বুঝি কেউ একজন পা চেপে ধরলো । তবে এই ভয়গুলো এখন আর বেশিক্ষন স্থায়ী হয়না । ভুত সমাজকে এখন আর অতোটা খারাপ বলে মনে হয় না । ভুত মানুষের তেমন কোন ক্ষতি করেনা , শুধু মাঝে মাঝে নিজের অজান্তে একটু আধটূ ভয় দেখিয়ে ফেলে । এর চাইতে একটা চাকুওয়ালা ছিনতাইকারী কিংবা ডাকাত অনেক বেশি ভয়ংকর ।

এইসব ফালতু লেখা পড়ে আমাকে হয়তো ‘ভীতুর ডিম’ ও ভাবতে পারেন । ভাবলে ভাবুন , আমি কিচ্ছু মনে করবোনা । তবে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে লিখছি, ছোট বাচ্চাদের যত বেশি সম্ভব ভৌতিক আলোচনা থেকে দূরে রাখবেন । বাচ্চাদের ভুতের ভয় দেখানো মোটেও উচিত না । এর একটা প্রভাব অনেকেই সারাজীবন বয়ে বেড়ায় । ভুতের সাথে যদি তাদের পরিচয় করিয়ে দিতেই হয় তবে যতটা সম্ভব ভুতকে ‘ভাল মানুষের’ কাতারে নামিয়ে আনতে হবে ।
ভবিষ্যতে আমার ছেলে মেয়ে যখন জানতে চাইবে ‘বাবা, ভুত কি ?’
আমি বলবো  ‘ভুত খুব মজার জিনিষ বাবা , এদের দেখা যায়না , কিন্তু এরা খুব উপকারী ,মাঝে মাঝে ভয় দেখিয়ে মানুষের সাথে একটু আধটু দুস্টুমি করে, কিন্তু অযথা কারো ক্ষতি করেনা’ ।

[বোবায় ধরার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাঃ ঘুমের ২ টা পর্যায় আছে। REM (Rapid Eye movement) and NON REM( Non Rapid Eye Movement).ঘুমের মধ্যে এ দুটি চক্র পর্যার ক্রমে আসে । কেউ যদি এই দুই ধাপের মাঝে জেগে যায় তাহলে হাত পা নাড়তে পারেনা , কথা বলতে পারেনা , কারন তখন এই জেগে থাকা সম্পর্কে মস্তিষ্ক অবগত থাকে না । এ অবস্থা থেকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে কয়েক সেকেন্ড থেকে কয়েক মিনিট পর্যন্ত সময় লাগতে পারে। এসময় কোন কিছু দেখা বা গন্ধ পাওয়া অস্বাভাবিক নয় কারন মষ্তিষ্ক তখন স্বপ্নের মত দৃশ্য তৈরী করতে পারে। যা অনেক সময় একেবারে বাস্তব বলে মনে হয় ]
[ভুল বানানের দায় নিজ গুনে ক্ষমা করিবেন , আমার কোন দোষ নেই , সব দোষ ভুতের]