২৯ নভেম্বর, ২০১২

‘মিস শকুন্তলা’ (শকুন্তলা অবলম্বনে রচিত)

১.
বাংলাদেশ রাজা-বাদশা পার্টির চেয়ারম্যান রাজা দুস্মন্ত বহুবিধ নারী কেলেঙ্কারিতে জড়াইয়া বর্তমানে তীব্র ইমেজ সংকটে ভুগিতেছেন । অথছ নির্বাচন দুয়ারে কড়া নাড়িতেছে । ইমেজ ফিরিয়া পাইতে রাজা দুস্মন্ত তাহার পার্টির স্থায়ী কমিটির সদস্যদের লহিয়া রুদ্ধদার বৈঠকের আয়োজন করিলেন । রাতভর বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হইল একখানা রোডমার্চ আয়োজন করার । ইমেজবৃদ্ধির এর চেয়ে ভাল উপায় আর নাই । তবে যেনতেন কারনে রোডমার্চ করিলে চলিবেনা । সিদ্ধান্ত হইল সাম্প্রতিক সময়ে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রোডমার্চ করা হইবে । ঢাকা টু গাজিপুর শালবন । আন্দোলনও হইবে কিঞ্চিত পিকনিকও হইবে । এ ব্যাপারে অনেকে আপত্তি জানাইয়া বলিলেন সিলেট,চট্রগ্রাম থাকিতে গাজিপুর কেন ? রাজা জানাইলেন ‘রাজা-বাদশা পার্টির’ রোডমার্চ গাড়ীর বদলে ঘোড়া দিয়া হইবে । সিলেট-চট্রগ্রাম যাওয়ার মত হর্সপাওয়ার গাড়ির থাকিলেও ঘোড়াদের আছে কিনা সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রহিয়াছে ।

নির্দিষ্ট দিনে সব মিলাইয়া সাতখান ঘোড়া লহিয়া রাজা দুস্মন্ত গাজিপুর রওনা করিলেন । চারখানা প্রাইভেট ঘোড়া আর তিনখানা ভাড়া । এই ধরনের বিরল সম্মানে ভূষিত হইয়া ঘোড়াদেরকে প্রচণ্ড আনন্দিত মনে হইতে লাগিল । মনের আনন্দে তাহারা খানিক পরপর ‘চিহহহহহহ’ করিয়া সেই আনন্দের বহিঃপ্রকাশ করিতে লাগিল ।

ঘোড়াবহরের সম্মুখে রাজা দুস্মন্তের ঘোড়া । সেই ঘোড়ার গলায় ঝুলিতে থাকা ব্যানারে লিখা ‘ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রোডমার্চ । আয়োজনে - বাংলাদেশ রাজা-বাদশা পার্টি’ । ‘মাই টিভি’ ও ‘মোহনা টিভি’ অনুষ্ঠানের অভাবে ব্যাপক আগ্রহ নিয়া সে রোডমার্চ সরাসরি সম্প্রচার করিতে থাকিলো ।


সকাল সাতটায় পল্টন হইতে রওয়ানা করিয়া বেলা ১২ টার দিকে রাজার ঘোড়াবহর উত্তরা পর্যন্ত আসিতে সক্ষম হইলো । এরপর আবার উত্তরার জ্যামে টানা ২ ঘন্টা রাজার ঘোড়া বহর একি স্থানে দাড়াইয়া রইল । এক জায়গায় দাঁড়াইতে দাঁড়াইতে বোধয় ঘোড়ার পা কিঞ্চিত চিনচিন করিয়া উঠিয়াছিল । তাই হটাত করিয়া ‘ধুর শালা’ বলিয়া সে সামনের গাড়িতে লাথি মারিয়া বসিল । ইহাতে বিস্তর বিপত্তি বাধিয়া গেল । গাড়ি হইতে চ্যাংড়া কতক যুবক নামিয়া গলা চড়াইয়া বলিল ‘হোই মিয়া, ঠিক মত ব্রেক চাপতে পারেন না ?’ শেষমেষ তাহাদিগকে গাড়ীর ক্ষতিপূরণ দিয়া রাজা বিবাদ মিটমাট করিলেন । ঘোড়াও লজ্জিত হইয়া নিজের ভুল স্বীকার করিয়া নিল ।

যাত্রাপথে ঘোড়াগুলো আর বিরক্ত করিলনা । চুপচাপ চলিতে লাগিলো । শুধুমাত্র প্রয়োজনের সময় ‘ওস্তাদ বায়ে চাপেন’ কিংবা ‘ডাইনে প্লাস্টিক’ বলিয়া ড্রাইভিং এ সাহাজ্য করিতে লাগিল ।

২.
দীর্ঘ প্রতিক্ষার অবশেষে রাজা দুস্মন্তের ঘোড়াবহর শালবনে আসিয়া পৌঁছাইলো । সেখানে উপস্থিত ‘বাংলাদেশ রাজা-বাদশা পার্টির’ জেলা আহবায়ক সম্পাদক তাহাদের বরন করিয়া নিলেন । উপস্থিত জনাদশেক নেতা-কর্মী ও সাতখানা ঘোড়ার সামনে ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে রাজা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিলেন । ভাষণের চোটে ঘোড়ারা পর্যন্ত তালি দিতে বাধ্য হইল । শুধু তাই না, আবেগের চোটে একখানা ঘোড়া চিৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল ‘অসাম সালা’ । রাজা সেই ঘোড়ার দিকে চোখ রাঙাইয়া তাকাইলেন । ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বক্তব্যের পর এমন ভারতীয় সংস্কৃতিকে মানিয়া লওয়া যায়না ।


শালবনে এক রেস্ট হাউসে রাজার থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা হইলো । রাজা মনে মনে ভাবিলেন বনে যখন আসিয়াছেন তখন ‘হরিণ’ শিকার করিতে বাহির হইলে মন্দ হয়না । রাজা তাহার ‘একে-৪৭’ আর গ্রেনেড লইয়া হরিণ শিকারে বাহির হইলেন । রাজনীতিবিদেরা অনেক বড় মাপের মানুষ । তাহারা শিকারও করেন বড় বড় অস্ত্র দিয়া ।

পার্টির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব আর যুগ্ম আহবায়ক সম্পাদক কে সাথে লইয়া ঘোড়ায় চড়িয়া রাজা শিকারে বাহির হইলেন । চলিতে চলিতে হটাত করিয়া যুবতী নারীদের কলকাকলি রাজার কানে আসিল । নারীদের প্রতি রাজার বরাবরি ভিন্ন রকম আগ্রহ । এককালে ভাড়া করা কবিদের মাধ্যমে নারীদের উদ্দ্যেশে লেখা কবিতা রাজা বিভিন্ন গনমাধ্যমে প্রকাশ করিতেন ।

ঘোড়া হইতে নামিয়া রাজা গাছের আড়াল হইতে দেখিতে পাইলেন কতক সুন্দরী রমণী পুকুরেতে জলকেলি করিতেছে । অতিশয় মনোরম দৃশ্য । রাজা ভাবিলেন জীবনে আর এমন দৃশ্য দেখার সুযোগ নাও হইতে পারে । তাই রাজা তাহার চায়নিজ গ্যালাক্সি-ট্যাব বাহির করিয়া রমণীদের জলকেলির দৃশ্য জুম করিয়া ভিডিও করিতে লাগিলেন ।

কিন্তু বিপত্তি ডাকিয়া আনিলো তাহার বডি স্প্রে । তরুণীদের আকৃষ্ট করিতে কোথাও বাহির হইবার আগে রাজা মিনিট দশেক সময় লইয়া শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গ প্রত্যঙ্গে স্প্রে করেন । আজকেও তাহার ব্যাতিক্রম ঘটে নাই । আর সেই গন্ধ টের পাইয়া জলকেলিতে মগ্ন থাকা তরুণীরা টেলিভিশনের বিজ্ঞাপনের ন্যায় পাগলের মত ছুটিয়া আসিল । রাজাও ভিডিও রেকর্ডিং অফ করিয়া কিছু একটা ঘটিবার প্রত্যাশায় দাড়াইয়া রইলেন । কিন্তু কিছুই ঘটিলো না । নিজ হইতে বেশী দূর আগাইবার সাহস বোধয় তাহাদের নাই । রাজার শরীর হইতে ১০-১৫ ফুট দূরে থাকিতেই তাহারা থামিয়া গেল ।

রাজার চরিত্রে সামান্য দাগ থাকিতে পারে কিন্তু তিনি মোটেও ‘লুইচ্চা’ প্রকৃতির না । পরিস্থিতি স্বাভাবিক করিতে তিনি নিজ হইতে তরুণীদের পরিচয় জানিতে চাহিলেন । তরুণীরা জানাইলো তাহারা ‘চাকা বল সাবান সুপারস্টার’ এর টপ টেন প্রতিযোগী । অনুষ্ঠানের শুটিঙের জন্য তাহাদিগকে এই নির্জন স্থানে আনা হইয়াছে । অতঃপর তাহারা প্রত্যেকে নিজ নিজ নাম বলিল । যাহার মধ্যে একজন ‘শকুন্তলা’ ।

শকুন্তলা ছিল অতিশয় সুন্দর এক রমনী । নিঃসন্দেহে সে ‘চাকা বল সাবান সুপারস্টার’ হইবার দাবীদার । রাজা এক্স-রে মেশিনের ন্যায় তাহাকে স্ক্যান করিয়া বুঝিলেন এমন রুপ-লাবন্য যৌবনভরা নারী তাহার এলাকায় কাহারো নেই । তাহার ১১৮ জন বেগমের মধ্যে কেহই শকুন্তলার ন্যায় আকর্ষণীয় নহে । অবশ্য লেবু চিপিলে উহার স্বাদ তিতা হইতে বাধ্য । সে কারনেই তাজা লেবু দেখিলে রাজার লেমন জুসের তৃষ্ণা বাড়িয়া যায় ।

রাজা দুস্মন্ত বাংলা সিনেমার স্টাইলে শকুন্তলার দিকে তাকাইয়া বলিলেন, ‘ইফ ইউ ডোন্ট মাইন্ড , আমি কি আপনাকে শুটিং স্পট পর্যন্ত পৌঁছাইয়া দিতে পারি?’ শকুন্তলা খুশী মনে রাজি হইলো । রাজা তাহার সঙ্গি সাথি ও উপস্থিত বাকী তরুণীদের মনে দুঃখ দিয়া শকুন্তলাকে ঘোড়ায় তুলিয়া লইলেন । ঘোড়ার পেছনের সিটে শকুন্তলাকে বসাইয়া রাজা ‘শর্ট টাইমের লং ড্রাইভে’ বাহির হইলেন । শকুন্তলাকে পেছনের সিটে বসাইবার অর্থ অন্যদের বুঝিতে কষ্ট হইলোনা । শকুন্তলাও সিট বেল্টের ন্যায় রাজাকে জড়াইয়া ধরিয়া যাত্রাকে উপভোগ্য করিয়া তুলিল । বিজ্ঞাপনের ভাষায় বলিলে ‘সাধ্যের মধ্যে সবটুকু সুখ’ !!!

মনোরম প্রকৃতির ভেতর দিয়া টগবগ করিয়া ঘোড়া ছুটিতে লাগিল । তবে প্রকৃতি যতই সুন্দর হউক আশে পাশে যুবতী নারী বসিয়া থাকিলে প্রকৃতির দিকে ফিরিয়া তাকাইবার সাধ জাগেনা । কারন যুবতী নারীই প্রকৃতির সর্বাপেক্ষা আকর্ষণীয় অংশ । উহাদের কেশের ঘ্রান যেকোন ফুলের চাইতেও বেশী সুবাসময় । শকুন্তলার উড়ন্ত কেশের ঘ্রান লইতে লইতে রাজা ঘোড়া ড্রাইভ করিতে লাগিলেন । ব্যাকভিউ মিররে সব দেখিয়া ঘোড়া নিচু স্বরে গান গাইতে লাগিলো ‘মে কারুতো সালা, ক্যারেক্টার ডিলা হ্যায় !!’

দুই মিনিটের পথ বিশ মিনিট লাগাইয়া রাজা শুটিং স্পটে আসিয়া পৌঁছাইলেন । ঘোড়া হইতে নামিয়া শকুন্তলা রাজাকে বলিল আমাকে ভোট করিতে ভুলবেন না কিন্তু , আমাকে ভোট করতে মোবাইলের ম্যাসেজ অপশনে গিয়ে টাইপ করুন এস- এইচ – ও –কে –ইউ – এন –টি – ও –এল –এ , ‘শকুন্তলা’ আর যত খুশী পাঠিয়ে দিন নাইন ত্রিপল সিক্স নাম্বারে ।‘

কিন্তু নাইন ত্রিপল সিক্সে কি আর মনের সাধ মিটে ? রাজা তাহার ভিজিটিং কার্ড শকুন্তলার হাতে দিয়া ফোন করিবার অনুরোধ করিলেন , কিন্তু বিনিময়ে শকুন্তলা তাহার ফোন নাম্বার দিয়া গেল না । রাজা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন ‘নারীরা শুধু কাড়িয়া নিতে জানে , কিছু দিতে জানেনা...’

৩.
শকুন্তলার প্রেমে পাগল হইয়া রাজা আন্দোলন সংগ্রামের কথা বেমালুম ভুলিয়া গেলেন । নিজের ভোট বৃদ্ধি করিতে মাঠে নামিয়া নিজেই অন্যকে ভোট করিতে ব্যাস্ত হইয়া গেলেন । সকাল হইতে রাত পর্যন্ত নাইন ত্রিপল সিক্স নাম্বারে ‘শকুন্তলা’ লিখিয়া এসএমএস করিতে করিতে তাহার হাত ব্যাথা হইয়া গেল । একটানা তিনদিন এসএমএস করার পর রাজার মনে হইলো তিনি কেন এমন পরিশ্রম করিয়া যাইতেছেন ? শকুন্তলা তাহার ভিজিটিং কার্ড নিয়া তাহাকে ফোন তো দূরের কথা একখানা মিসকলও দেয় নাই । তাহলে কেন তিনি এসএমএস এর পেছনে এতো এতো অর্থ আর সময় ব্যায় করিতেছেন ?

শকুন্তলার প্রতি রাজা ক্রোধ জন্মিলো । এসএমএস এর প্রতিশোধ রাজা এমএমএস দিয়া লইবার সিদ্ধান্ত গ্রহন করিলেন । পুকুরপাড়ে ধারন করা শকুন্তলার জলকেলির ভিডিওর নতুন নাম দিলেন ‘shokuntola’s unreleased bath scene video’ আর সেই এমএমএস সেন্ড করিলেন...

৪.
শকুন্তলা ‘চাকা বল সাবান সুপারস্টার’ হইতে পারিল কিনা তাহা জানা যায়নি তবে পর্ণোগ্রাফির অভিযোগে রাজা দুস্মন্তের ১০ বছরের জেল আর ৫ লক্ষ টাকা জরিমানা হইয়া গেল । ইমেজ বৃদ্ধি করিতে বাহির হইয়া ‘বাংলাদেশ রাজা-বাদশা পার্টির’ ইমেজ চিরতরে ধুলায় মিশিয়া গেল ।